উদ্যোক্তা নাকি রি-সেলার
আয়শা সিদ্দিকা হুমায়রা :
“আমি….., কাজ করছি…….নিয়ে”, এরকম হাস্যরসাত্মক কিছু পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট ফেসবুক গ্রুপকে এর পটভূমি হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে,যারা মূলত উদ্যোক্তা নিয়ে কাজ করেন। অনেকেই মনে করছেন চলমান করোনা পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ঝাঁকে ঝাঁকে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। এরা বেশিরভাগ নিজেদের উদ্যোগ শুরু করেছেন এটা ভেবে যে, আশে পাশে অমুক তমুক ব্যবসা করে বেশ টাকা কামাচ্ছে। এ আর এমন কী! আমিও শুরু করে দিই, খুব সহজ, ছবি তুলে আপলোড করবো আর বিক্রি করবো ইত্যাদি ইত্যাদি।
সৃজনশীল কিছু করার থেকে টাকা ইনকামের ব্যপারটাই তাদের কাছে মুখ্য। এই ভুল ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করার ফলে কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের ভুল ভাঙতে থাকে এবং যতটা হুট করে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিলো ততই দ্রুত তারা আবার নিস্প্রভ হয়ে যান। এদের বেশিরভাগ আবার প্রোডাক্ট কিনে আবার পুনরায় বিক্রি করেন। তাদের ঠিক উদ্যোক্তা বলা যায় কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাদেরকে ছোট করাটা আমার উদ্দেশ্য না কিন্তু আমার মনে হয় তাদের ক্ষেত্রে রি-সেলার পরিভাষা ব্যবহার করাটাই যথোপযুক্ত।
উদ্যোক্তা পরিভাষার সাথে আরো অনেক কিছু জড়িয়ে আছে, যেমন একজন উদ্যোক্তা ইনোভেটিভ হবেন, নতুন নতুন আইডিয়া ডেভেলপ করবেন, নিজের অর্থ এবং শ্রম দিয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করবেন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার আশায়। এই দুইয়ের মিল থাকলেও একটি বড় আকারে পার্থক্য রয়েছে। যেমনঃ-একজনের লক্ষ্য শুধুই মুনাফা অর্জন আর অন্যজনের লক্ষ্য নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে দ্বিতীয়জনের কাজ প্রথম জনের তুলনায় বেশি পরিশ্রমসাধ্য বলেই মনে হচ্ছে।
এবার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, বেশ কিছুদিন আগে এক আন্টি আমাকে বলেছিলেন তিনি অনলাইন বিজনেস (রি-সেলিং) করতে চান। এক্ষেত্রে আমি তাকে হেল্প করতে পারবো কিনা, যেহেতু অনলাইনে তার অভিজ্ঞতা কম। আমাকে বলা হয়েছিলো ফেসবুকে গ্রুপ তৈরি করে সেখানে মেম্বার ইনভাইট করতে এবং পণ্যের ছবি পোস্ট করতে। সপ্তাহ না পেরোতেই কেন বিক্রি হয়না, অন্যদেরতো বিক্রি হয় তার কেন হয়না ইত্যাদি নিয়ে আমার মাথা খারাপ করার জোগাড়! আমি বলেছিলাম পণ্যের মূল্য অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু তার কথা হলো সে যে টাকা ইনভেস্ট করছেন তার ডাবল মুনাফা না হলে পোষাবে না। ফলাফল হলো আমি সেখানে থেকে সরে আসলাম। পরে শুনেছি সে অন্যদেরকে বলে বেড়ায় আমার জন্য তার লোকসান হয়েছে। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে আপনারাও সহমত প্রকাশ করবেন যে, আমরা এরকম উদ্যোক্তা চাই না।
আমার পরিচিত অনেকেই ই-কমার্স নিয়ে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের ডেডিকেশন সত্যিই প্রশংসনীয়। আমার অর্ধাঙ্গ চাকুরির পাশাপাশি প্রায় তিন বছরের অধিক সময় ধরে এই ফিল্ডে তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, সাথে যুক্ত আছে তার বন্ধুর রাত-দিন এক করা পরিশ্রম। সততা এবং পণ্যের মান ধরে রেখে নতুন নতুন আইডিয়া ডেভেলপের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। আমি দেখেছি তবুও তারা নিজেদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে যথেষ্ট সংকোচবোধ করেন। তাদের পরিশ্রম এবং ধৈর্য্যশক্তি অন্য উদ্যোক্তাদেরও পথ দেখায়।
এবার আবার শুরুর কথায় ফিরে যাই, অনেকে এটাও মনে করছেন যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই হাস্যরসাত্মক পোস্ট নতুন উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে। আমি এর সাথে সহমত পোষণ করছি একইসাথে এতো ঠুনকো আত্মবিশ্বাস নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া যায় কিনা এ ব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করছি। অধিক পরিমাণে উদ্যোগ গ্রহণ এবং উদ্যোক্তা তৈরি আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। একই সাথে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো সবচেয়ে জরুরি।
একজন সৃজনশীল, আত্মবিশ্বাসী, পরিশ্রমী ও সচেতন উদ্যোক্তা দেশ ও জাতি উভয়ের কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সে নিজেকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি অন্যকে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত বা সাহায্য করে বেকারত্ব দুরীকরণে অবদান রাখতে পারবে। তাই রাতারাতি লাভবান হওয়ার চিন্তা থেকে অথবা অমুক তমুকের প্রতি ঈর্ষাণ্বিত না হয়ে নিজের মেধা, প্রজ্ঞা, আত্মবিশ্বাস এবং উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়ে উঠুন। আর এজন্য অবশ্যই অধিক পরিমাণে জ্ঞানার্জনের বিকল্প কিছু নেই।
বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশ্লেশনধর্মী লেখা।
এককথায় অসাধারণ!